সুই সুতায় নেই করোনার ভয়! - অজানা ১০১
,

Post Top Ad

.com/blogger_img_proxy/.com/blogger_img_proxy/

Thursday, April 30, 2020

সুই সুতায় নেই করোনার ভয়!

no_image_card

ওয়াসিম ফারুক

দেশের খ্যাতনামা এক ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকের সাক্ষাৎকারে শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, বেশিরভাগ দেশ শিল্পকারখানা খুলে দিচ্ছে। আমাদেরও খুলতে হবে। তিনি তার সাক্ষাৎকারের আরও বলেন, বিজিএমইএর একটি নীতিমালা ও সরকারের স্বাস্থ্যবিধির কথা বলেছেন। সেই সাথে তৈরি পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনাম শিল্পকারখানা খুলে দেয়ায় আমাদের তৈরি পোশাক কারখানা তাদের অর্ডার বা কার্যাদেশ হারাতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তিনি দেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তার চিন্তাধারা নিয়ে বিশ্লেষণ বা সমালোচনার যোগ্যতা আমার নেই।

তার দৃষ্টিভঙ্গি ও মন্তব্য দেশ ও জাতির স্বার্থে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য তবে আমাদের দেশ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এর প্রয়োগ ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই থেকে যায় প্রশ্ন। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারই আমাদের দেশের শ্রমিকদের পুতুল নাচের পুতুলে পরিণত করেছে। তথাকথিত শ্রমিক সংগঠনগুলো তাদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য সংগঠনকে ব্যবহার করে আসছে। শ্রমিক সংগঠনের নেতারা ও এই পুঁজিবাদীদেরই একটি অংশ।

আমাদের রফতানি আয়ের বড় অংশই আসে পোশাকশিল্প থেকে এটা যেমন সত্যি। এই শিল্পের শ্রমিকদের করুণ কাহিনী ও আমরা প্রতিনিয়তই শুনি। পোশাকশিল্প মালিকদের পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্য অনেক শ্রমিককেই জীবন দিতে হয়েছে। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকেণ্ডে ১১৭ পোশাক শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছিল। এই ঘটনার পর সংসদের এক আলোচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এ ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে”।

বাংলাদের পোশাকশিল্পের বড় ট্র্যাজেডি সাভারের রানাপ্লাজা। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানাপ্লাজার পুরো ভবন ধসে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় প্রায় ১২০০ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্পদুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু দুর্ঘটনায় অনেক শ্রমিককেই জীবন দিতে হয়েছে। বিশ্বজুড়ে করোনার থাবায় আমাদের রফতানিখাত বিশেষ করে পোশাকখাত বিরাট হুমকির মুখে। আমাদের পেশাকশিল্পে এরই মধ্যে সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের এই শিল্প টিকে আছে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভর করে। সেসব দেশে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে বহু পশ্চিমা ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে তাদের অর্ডার বাতিল কিংবা স্থগিত করছেন। যা আমাদের অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখকর নয়।

তৈরি পোশাক রফতানিতে আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভিয়েতনামে করোনার থাবা প্রথমই আঘাত হানে চীনে। একটি অপরিচিত মরণভাইরাসের আক্রমণ চীন কীভাবে প্রতিহত করছে তা বিস্ময় করছে। আর যদি আসি ভিয়েতনামের কথা এরা তো করোনা প্রতিরোধে আশ্চর্য করছে বিশ্ববাসীকে। ১০ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ২৬৮ আক্রান্তের মধ্যে কোনো মৃত্যু ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করেছে করোনাকে। কিন্তু আমারা করোনা নিয়ে যাতা করছি যা কোনো সুস্থ পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইতোমধ্যে আমাদের করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার খুবই উদ্বেগজনক। প্রতিদিনই আক্রান্তের সূচক উপরে দিকে। আবার যথেষ্ট পরীক্ষাও হচ্ছে না। পরীক্ষা হলে ও ফলাফল যথাসময়ে পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকাফেরত পিরোজপুর সদর উপজেলার এক গার্মেন্টকর্মীর নমুনা পরীক্ষায় জানা গেছে তিনি করোনা পজিটিভ। কিন্তু রিপোর্ট আসার আগেই তিনি ঢাকার আশুলিয়ায় তার কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। ২৮ এপ্রিল পিরোজপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এমনই এক ভয়ংকর তথ্য জানিয়েছেন। যা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। ২৩ এপ্রিল নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য বরিশালে পাঠানো হলে ২৭ এপ্রিল রাতে তারা রিপোর্ট হাতে পান। এর মধ্যে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে ২৫ এপ্রিল তাকে চাকরির রক্ষায় আশুলিয়া আসতে হয়। সব জায়গাই দায়িত্বজ্ঞান আর পেটের ক্ষুধা নিয়েই প্রশ্ন।

গত কয়েক দিন আমরা জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাধারণ মানুষের সরকারি খাদ্য সহায়তা নিয়ে তো আর ঘৃণিত কাণ্ড দেখলাম। তবে সবচেয়ে হতাশ করছে আমাদের তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের কাণ্ড দেখে। গত ৫ এপ্রিল যখন কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হয় তখন ঢাকামুখী মানুষের ঢল নিঃসন্দেহে ছিল একটা অমানবিক কাজ। পেটের ক্ষুধা, চাকরি রক্ষা আর করোনায় মৃত্যুর ভয় তাড়া করছিল আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদের। এরপর যখন নানা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় শিল্প মালিকদের তারপর তারা সরকারের পরবর্তী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির সাথে তাদের ছুটি ও বর্ধিত করেন। এরপর গত ২৫ এপ্রিল বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সীমিত পরিসরে কারখানা চালু করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমরা যা দেখলাম তা হলো বেশিরভাগ কারখানাই কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি রবং সেই গাদাগাদি পরিবেশেই চলছে অধিকাংশ কারখানা।

পোশাক শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যেই দুই শতাধিক শ্রমিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যা সত্যি উদ্বেগের বিষয়। এর মধ্যে প্রতিদিনই খবর আসছে বিভিন্ন স্থানে বেতনের দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ ভাঙচুরের কাহিনী। সরকার ইতোমধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন পোশাকশিল্প মালিকদের পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়ার পরও কেন শ্রমিকদের বেতনের জন্য আন্দোলন করতে হবে এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কেন মালিকরা তাদের শ্রমিকদের বেতন দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন কেন শ্রমিকরা বেতনের জন্য আন্দোলন করছেন তা একটিবারও কি সঠিকভাবে বিজিএমইএ ও সরকার ভেবে দেখেছে?

আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে আক্তান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলছে। তার মধ্যে সীমিত পরিসরে খোলার কথা বলে একে একে অনেক কারখানাই খুলে দেয়া হচ্ছে। যেখানে শারীরিক দূরত্ব স্বাস্থ্যবিধি কোনোভাবেই মানা সম্ভব না। করোনা একটি ভয়াবহ ছোঁয়াচে ভাইরাস আর তৈরি পোশাক কারখানায় প্রতিটা কাজেই একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত তাই এখানে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা যথেষ্টভাবেই থেকেই যাচ্ছে।

সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইনের (এসইউটিডি) ডেটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকদের মতে, বাংলাদেশ থেকে ১৯ মের মধ্যে ৯৭ শতাংশ, ৩০ মে মধ্যে ৯৯ শতাংশ বিলীন হবে আর পুরোপুরি বিলিন হতে সময় নেবে ১৫ জুলাই। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) রোগতত্ত্ববিদ এবং ভাইরোলজিস্টদের মতে, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে দুই ধাপে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ হতে পারে। প্রথমটি হতে পারে মে থেকে মে মাসের শেষ নাগাদ। তবে সর্বোচ্চ সংক্রমণ দুই মাসের মধ্যেই ঘটবে। সে হিসেবে মধ্য জুন পর্যন্ত যেতে পারে। অবশ্য এসব কিছুই নির্ভর করছে করোনা নিয়ন্ত্রণে দেশে নেয়া কর্মসূচিগুলো ঠিক কতটা সঠিকভাবে মানা হয়, সেটার ওপর। আমাদের বর্তমানে করোনার যে সংক্রমণের হার তাতে কোন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি) এমন রিপোর্ট তৈরি করছে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যায়।

ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুরক্ষা না দিলে করোনাভাইরাসের মহামরি আশঙ্কা করে এক বিবৃতিও দিয়েছে। বিবৃতিতে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে আইএলওর বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পটিআইনেন বলেন, ‘যেহেতু কিছু কিছু শিল্প ধীরে ধীরে কার্যক্রম শুরু করছে, আইএলও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরাপদে কাজে ফিরে আসা নিশ্চিত করতে একটি তিন ধাপের কৌশল তৈরি করেছে। প্রথম পদক্ষেপ হলো নিয়োগকারী ও শ্রমিকের মধ্যে আলোচনার ওপর ভিত্তি করে কাজের জন্য বেশ কয়েকটি সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা গ্রহণ এবং করোনাভাইরাসের ঝুঁকি ভাগ করে নেয়া।’

উৎপাদন বন্ধ করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব নয়। তবে অর্থনীতির চাকা সচল করতে গিয়ে করোনার ভয়াবহ থাবা যদি কড়ালভাবে গ্রাস করে আমাদের দেশে মহামরির মহাবির্পযয় নেমে আসে তবে সেই বির্পযয় থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা খুবই মুশকিল হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশার কথা আমাদের সকলের কাছেই স্পষ্ট। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাসাধ্য চেষ্টা করেও বিশেষ বিশেষ কারণে মানুষকে পুরোপুরি ঘরমুখী করতে পারেনি। এরপর কারখানা খুলে দেয়ার কারণে শিল্পাঞ্চলে লোকসমগম কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। তাই সব মিলিয়ে করোনার ভয়াবহতা আমাদের কোন দিকে নিয়ে দাঁড় করায় তা বলা খুবই মুশকিল। তবে এতটুকু আশা করব দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের মানুষকে করোনার ভয়াবহ ছোবল থেকে রক্ষা করতে সরকার ও কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেবেন।

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/বিএ/জেআইএম

No comments:

Post a Comment